বিন্দু আর শোভনের পরিচয় হয় ঢাকায় একটা কনফারেন্সে। বিন্দু চাকরি করে একটি প্রাইভেট ব্যাংকে আর শোভন বহুজাতিক মোবাইল ফোন কোম্পানিতে। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব তারপর প্রেম অতঃপর বিয়ে। ওদের দুইজনের পরিবার থাকে ঢাকার বাইরে। ওরা দুইজন চাকরি করে, বেশ ভালো করেই দিন চলে যায় তাদের, ধানমন্ডি এলাকাতে দুই বেডরুমের বাসা ভাড়া করে থাকে ওরা।
এবার একটু ওদের পরিবারের কথায় আসা যাক। শোভনের মা-বাবা আর ছোট ভাই থাকে যশোরে, ওর বাবা কলিম সাহেব যশোরে একটি এনজিওতে একাউন্টসে চাকরি করতো আর অবসর নেয়ার পর এখন পূর্বপুরুষের জমি-জমা তদারকি করে। মা মাহবুবা খাতুন গৃহিণী। শোভন পড়ালেখায় ভালো হলেও তার ছোট ভাই সোহান কোনরকমে ডিগ্রী পাস করেছে ,এখন যশোর শহরে একটা সাইবার ক্যাফের দোকান দিয়ে বসেছে, জলি নামের একটা মেয়ের সাথে সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। জলি এস এস সি পাস করেছে গত বছর তবে এইচ এস সি তে ভর্তি হতে পারেনি আর। এবার বলি বিন্দুর পরিবারের কথা। বিন্দুর বাবা খোরশেদ সাহেব লালমনিরহাট শহরে একটি সরকারি হাই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক আর মা নার্গিস আরা একি শহরে একটি ছোট সেলাই স্কুলের কর্ণধার।
আর বিন্দুর ছোট ভাই বৃত্ত দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বৃত্ত এমন একজন ডাক্তার হতে চায় যার উদ্দেশ্য শুধু টাকা কামানো নয়, হত দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায় তার সেবার মাধ্যমে। বিন্দু আর শোভনদের পরিবারের মধ্যে শোভনদের অর্থনৈতিক অবস্হা ভালো কারণ তাদের জমি-জমা বেশ আছে গ্রামে আর শোভনের বাবা যশোর শহরে একটু একটু করে জমি-জমা করেছেন। অপরদিকে বিন্দুর বাবা খোরশেদ সাহেব আর মা নার্গিসের লালমনিরহাট শহরের এই পৈতৃক ভাবে পাওয়া পুরোনো দোতালা বাড়িটি ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই বললে চলে। বাড়িটির একতলায় ওরা থাকে আর দোতলা ভাড়া।
তবে এই দম্পতি একটু অন্যরকম। বছরে কিছু টাকা তারা কষ্ট করে হলেও জমাতেন, আগে যখন ছেলেমেয়েরা ছোট ছিলো তাদের নিয়ে যতটা সম্ভব কম খরচের মধ্যে বছরে একবার বেড়াতে যেতেন। বিন্দু আর বৃত্তের অনেক ছোটবেলাতেই কক্সবাজারে যাওয়া হয়ে গিয়েছে। রাংগামাটি, কুষ্টিয়ার লালন শাহের আখড়া, সিলেটের চা-বাগান সব দেখেছে তারা তবে তার জন্য মা-বাবার শর্ত পূরণ করতে হতো ওদের, পরীক্ষায় ভালো ফল করলেই তবে ওদের নিয়ে বেড়াতে যেতো। বলা যেতে পারে বৃত্ত আর বিন্দুর বছরের এই বেড়ানোর জন্য বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম তিন জনের মধ্যে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা থাকতো আর এখন বয়স হয়ে গিয়েছে বলে খোরশেদ আর নার্গিস তেমন ঘোরাঘুরি না করতে পারলেও এদিক-সেদিক সময় পেলেই যান ার তারা এমন করেন কারণ এতে তাদের শরীর-মন দুই প্রফুল্ল থাকে আর কাজের করার ক্ষেত্রে উদ্যম থাকে।
তিন বছরের বিবাহিত জীবনে শোভন আর বিন্দুর বোঝাপড়া বেশ ভালো হয়ে গিয়েছে। রোযার ঈদে ওরা যায় লালমনিরহাটে আর কুরবানি ঈদে যায় যশোরে। আর এর মধ্যে যদি টুকটাক ছুটি পায় সাধ্যের মধ্যে প্যাকেজ পেলে ঘুরে আসে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়। বছরে যখন ওরা বাড়িতে যায় তখন ওরা সময়টাকে খুব সুন্দর করে কাটায় তাদের পরিবারের সাথে। লালমনিরহাটে গেলে ওরা গাড়ি ভাড়া করে উত্তরবংগের দর্শনীয় জায়গায় বেড়াতে যায় সবাই মিলে, খুব ভালো কাটে দিনগুলো। তবে যশোরে সেটা একবারেই আলাদা। অনেকবার শোভন আর বিন্দু চেয়েছে পরিবারের সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যেতে তবে কোনভাবেই তাতে সায় নেই কলিম আর মাহবুবার। এখন পর্যন্ত সোহান তার শ্বশুড় বাড়ি এক রাতের জন্য যায়নি বিয়ের আট মাস হলেও অথচ সেটা যে খুব দূর তাও না। শোভন আর বিন্দু যশোর শহরে রিক্সা নিয়ে ঘুরতে বের হলেও তাতে থাকে তাদের বিরক্তি। মাহবুবা তো মনেই করে যে সব হলো বিন্দুর বাড়াবাড়ি।
জলির জন্য খারাপ লাগে বিন্দুর। বাচ্চা মেয়ে সারাদিন সংসারের কাজ করার পর সন্ধ্যার সময় যখন একটু টিভি দেখতে বসে বা তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে তখন কলিম সাহেব মাগরিবের নামায সেরে আসার পথে বাজার থেকে গুড়া মাছ আনেন বা অন্য বাজার আনেন বেশিরভাগ দিনেই আর হুকুম করেন রাতের খাবারে সে মাছ যেন টেবিলে থাকে। অগত্যা জলি বসে মাছ কুটতে আর মাহবুবা রান্না করেন কারণ কলিম সাহেবের মাহবুবার হাতের রান্না মাছ বা মাংশ ছাড়া মুখে উঠেনা। কলিম সাহেব তার স্ত্রী আর ছোট ছেলের বউয়ের জন্য হাজারোটা শক্ত নিয়ম দিয়ে রেখেছেন। বিন্দু শোভনকে বলে তার বাবার সাথে কথা বলতে যেন নিয়মগুলো একটু শিথিল করেন উনি বাড়ির মেয়েদের জন্য। শোভন দায়সারা বলে যেমন চলছে চলুক, দুই দিনের জন্য এসে নাক গলানোর মানে নেই কারণ সে জানে তার বাবা কোনভাবে বদল হবেনা।
তবে বিন্দুর মনে চলে অনেক ভাবনা। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে বাবা বিকেলে স্কুল থেকে আসলে মা সেলাই শিখাতেন মেয়েদেরকে; ছেলে-মেয়েকে বিকালের নাস্তা, স্ত্রীর জন্য চা বানিয়ে দেয়া, রাতের খাবার গরম করে টেবিলে দেয়া, ছুটির দিনে বাসা পরিষ্কার সহ আরো অনেক কাজে সাহায্য করতো বিন্দুর বাবা, মাঝে মাঝে বাবা মাকে নিয়ে সন্ধ্যায় হাটতে যেতো বা রিক্সায় ঘুরতে যেতো একটা অন্যরকম বন্ধুত্ব ছিলো মা-বাবার মধ্যে। অথচ তার শ্বশুড় এখনো তটস্হ করে রাখে তার শাশুড়ীকে, জীবনের এই প্রারম্ভে এসে গরমের মধ্যে বাতের ব্যথা নিয়ে চুলার পাড়ে দাঁড়িয়ে রান্না করতে হয় মাহবুবার, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত জলির ফরমায়েশ খাটতে হয় শ্বশুড়-শাশুড়ীর, তিন মাসের গর্ভবতী মেয়েটার দিনে বিশ্রাম করার সুযোগ ও হয়না। যে কাজ ইচ্ছা করলেই বাড়ির কাজের মানুষ করতে পারে নিয়মের জন্য জলিকেই সেটা করতে হয়।আজ শিক্ষায় চাকরিতে স্বাবলম্বী বলে জলির মতো জীবন হয়নি বিন্দুর, বিন্দু ভাবে সোহানের কি একটু ইচ্ছা করেনা বউকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার, রিক্সায় বসে বাদাম খেতে খেতে খুনসুটি করার,কত ই বা বয়স সোহান-জলির। শুধুমাত্র নিয়মের জন্য বিয়ে হতে না হতেই বাচ্চা নিচ্ছে, তারা দুইজন দুইজনকে ঠিক ভাবে চিনতে পারলোনা পর্যন্ত।
একবার বিন্দু সাহস করে কলিম সাহেব আর মাহবুবাকে বলেই বসে যেন উনারা দুইজনে কক্সবাজারে ঘুরে আসেন। বিমান খরচ, হোটেল ভাড়া সব দিবে শোভন আর বিন্দু এমনকি সাথে করে নিয়ে যেতে চাইলো। তাতে আগুন হয়ে গেলেন কলিম সাহেব। বললেন টাকা তার আছে বেড়াতে যাওয়ার কিন্তু এইসব খাতে টাকা নষ্ট উনি করবেন না। বিন্দু ভেবেছিল উনারা গেলে পরে জলি আর সোহানের জন্য সুযোগ হবে বেড়াতে যাওয়ার কিন্তু তা আর হলো কই!
আচ্ছা ভাবুন তো এমন সব নিয়ম দিয়ে কি হবে যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা এতো ফরমাল থাকে, বাজার-সংসার-রান্না এতো সব দায়িত্বের ভিড়ে কি দুইজন মানুষের নিজ ভুবনে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে মন চায়না? কেন মাহবুবা বিরক্ত হয় শোভন আর বিন্দু ঘুরতে গেলে কারণ কলিম সাহেব কখনো তাকে নিয়ে সামনের রাস্তায় ও হাত ধরে হাঁটেননি, জীবনের এই আনন্দ সে কখনো ভোগ করেনি, সংসার,নিয়ম, সন্তান প্রতিপালনে হারিয়ে গিয়েছে মাহবুবার যৌবন। আর তাই উনি ভাবে জলির জীবনটাই স্বাভাবিক, বিন্দুরটা আদিখ্যেতা। আচ্ছা কলিম সাহেব কি পেলেন জীবনে এতো নিয়ম দিয়ে, শোভন জীবনে ভালো করলেও সোহান তো পারলোনা আর এদিকে শোভনটা নিজের পরিবারের হেন নিয়মের জন্য দায়সারা থাকে, এড়িয়ে চলে নিজের পরিবারকে কারণ সে এই অপ্রয়োজনীয় শক্ত নিয়মের পক্ষপাতী না। অপরদিকে খোরশেদ সাহেবের দুই সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত, চিন্তায় প্রগতিশীল, মা-বাবার সাথে সুন্দর করে সময় কাটাতে ভালোবাসে।
পরিশেষে এই বলবো, নিয়ম ছাড়া জীবন চলে না তবে সেই নিয়মটা যেন এমন না হয় যা কাছের মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়, নিয়মের বেড়াজালে আটকে যেন মানুষ মানুষরূপী যন্ত্র না হয়ে যায়। আবেগ অনুভূতি ছাড়া মানুষ নেই পৃথিবীতে। যেই মানুষগুলো সারাজীবন নিজেদের আবেগকে দমিয়ে রেখেছে, লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে তারা অন্যের আবেগকে মূল্যায়ন করবে না এটাই স্বাভাবিক। আর তাই বিন্দুও বুঝে মাহবুবাকে। বিন্দু হাল ছাড়েনি। আজো চেষ্টায় আছে কলিম সাহেব আর মাহবুবার দৃষ্টিভংগি বদল করার কারণ বিন্দু চায় খোরশেদ আর নার্গিসের মতো তারা ও একটা সুন্দর দাম্পত্য জীবন পালন করুক কারণ তারাও তার মা-বাবা। তাদের জীবনের প্রভাব পড়বে জলি আর সোহানের উপর। কারণ আজকের জলি আর সোহান তো আগামীদিনের কলিম আর মাহবুবা। পরিবর্তনটা আজ না আসলে আর কখনোই আসবেনা।
loading...
loading...
ভালো লাগল
অনেক ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই কবিকে।শুভ সন্ধ্যা
প্রীতিময় শুভেচ্ছা ও ভালবাসা –
loading...
"নিয়ম ছাড়া জীবন চলে না তবে সেই নিয়মটা যেন এমন না হয় যা কাছের মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়, নিয়মের বেড়াজালে আটকে যেন মানুষ মানুষরূপী যন্ত্র না হয়ে যায়। আবেগ অনুভূতি ছাড়া মানুষ নেই পৃথিবীতে।" ভাল বিশ্লেষণ।
loading...
লিখাটি পড়লাম। সহমত আপনার সাথে। পরিবর্তন প্রয়োজন।
loading...
* আসলেই দরকার পরিবর্তনটা…
loading...